ব্রাইডাল মেকওভার বা বিয়ের সাজে নতুন মাত্রা যোগ করেছে গুলশানের অভিজাত রূপচর্চা কেন্দ্র গালা মেকওভার স্টুডিও অ্যান্ড স্যালুন। মেকআপে ভালো প্রোডাক্ট ব্যবহার, কাজের মান আর পেশাদারিত্বের কারণে অল্প সময়েই রূপসচেতন নারীদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সেইসাথে ব্রাইডাল মেকওভারে গালার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হলেন মেকআপ আর্টিস্ট নাভিন আহমেদ। সম্প্রতি আমরা কথা বলেছি এই গুণী মানুষটির সাথে। তিনি কড়চা’কে বলেছেন তার প্রতিষ্ঠানের মেকআপের বিশেষত্ব এবং সফলতার পিছনের গল্প। সেগুলো পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন নওশীন শর্মিলী
স ফ ল তা র গ ল্প
ছোটবেলায় ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন নাভিন আহমেদ। তার শৈশব-স্বপ্ন ছিল চিত্রশিল্পী হওয়া। স্কুলে পড়াকালীন ছবি এঁকে পুরস্কারও জিতেছেন অনেক। সাজগোজ আর মেকআপের সঙ্গে তার সখ্যতাও গড়ে ওঠে সেই সময় থেকেই। নিজে সাজতে পছন্দ করতেন। তবে বেশি ভালো লাগত অপরকে সাজাতে। পরিবার, নিকট আত্মীয় আর বন্ধুদের সাজিয়ে দিতেন। মানুষের মুখ—ধীরে ধীরে তার ছবি আঁকার ক্যানভাস হয়ে ওঠে। সানবীমস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে নাভিনের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শুরু। সপ্তম শ্রেণি থেকে ‘ও’ লেভেল পর্যন্ত পড়েছেন স্কলাসটিকা স্কুলে। তিনি ২০০২ সালে ‘ও’ লেভেল সম্পন্ন করেন। পরে ‘এ’ লেভেল না করে দেশের বাইরে কমিউনিটি কলেজে পড়তে চান বলে বাসায় জানালেন। ইচ্ছা মেকআপের ওপর একটা কোর্স করা। প্রথমে সামান্য সমস্যায় পড়লেন। বাবা-মা মেকআপ শিখতে বিদেশে যেতে দিতে চাননি। তার পরিবারে থেকে তখনো কেউ বাইরে পড়তে যায়নি। বাবাকে রাজি করাতে তার বেশ কষ্ট হলো। নাভিন ২০০৪ সালে পাড়ি জমান কানাডায়। টরন্টোর শেরিড্যান কলেজে কসমেটিক টেকনিক্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। সেখান থেকেই তার মেকআপের ভুবনে যাত্রা শুরু হয়। কিছু কিছু জায়গায় কাজও করেছেন। কয়েকটা স্মল মুভি প্রোডাকশনের জন্য কাজ করেছেন জুনিয়র ইন্টার্ন হিসেবে। সেখানেও কিছুটা অভিজ্ঞতা সঞ্চার হয়েছে। ২০০৭ সালে তিনি ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপণন (মার্কেটিং) বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পড়াশোনা শেষ করে ওই বছরেই ঢাকায় ফিরলেন। এরপর তার হ্যাজবেন্ড রিয়াদের সাথে সাক্ষাত হয়। তখনো মেকআপ নিয়ে ক্যারিয়ার স্টার্ট করেননি। ২০১০ সালে রিয়াদের সাথে তার বিয়ে হয়। নাভিনের ভাষ্যে, ‘ও সবসময় আমাকে উত্সাহ দিত। সে দেখত এটা আমার প্যাশন, আমি চাই এটা ফলোআপ করতে। তাই আমাকে বলত, তুমি করো। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বাসা থেকেই স্টার্ট করব। দেখতে চাইলাম কেমন যায়? প্রথমে আমার কিছু বন্ধুদেরকে আমার মডেল বানাই। পাঁচ-ছয়জনকে মেকআপ দিই। একটা ফটোগ্রাফার বন্ধু ছিল। ও তখন ক্যারিয়ার স্টার্ট করছিল। ওকে দিয়েই ফটোশুট করালাম। ওই ছবিগুলো দিয়ে ফেসবুকে পেজ খুলি। ধীরে ধীরে নাম বেশ ছড়িয়ে গেল। তখন আমার প্রথম ব্রাইডাল অফারটা পেলাম। আমার বাসায় বেডরুমের পাশে একটা রুম ছিল। ওটায় আয়না ও লাইট লাগিয়ে নিলাম মেকআপের জন্য যতটুকু দরকার। সেখানেই শুরু হলো মেকআপের কাজ। ওই রুমে প্রায় চার বছরের মতো কাজ করেছি। কয়েকবার আমি মানুষের বাসায় গিয়েও কাজ করেছি। ফ্রিল্যান্সার মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে অনেকেই বাসায় ডেকে নিত ব্রাইডাল মেকআপের জন্য। এসময় আমার ক্লায়েন্ট বাড়তে থাকল। তখন আর বাসার সেটআপে কুলাচ্ছিল না। কারণ আমি কজনকে ড্রয়িং রুমে বসাব। আমার হাজবেন্ড বাসায় আসার সময় হলে বলতে হতো প্লিজ এখন এসো না। বাসায় এখনো অনেক বউ। তুমি একটু ঘুরে এসো। এরমধ্যে আমার ছেলে হলো। বাসার পরিবেশটা ঠিক রাখতে তখন পার্লারের জন্য একটা জায়গা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বনানীতে একটা ১৫০০ স্কয়ার ফিটের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম। ওখানে আমার পার্লার চালু করলাম। সেখানে ক্লায়েন্ট আরও বাড়তে থাকল। সেখানে দুই বছরের মতো থাকলাম। কেননা ওই অ্যাপার্টমেন্টের অন্য বাসিন্দারা কমপ্লেন করল, এত গাড়ি আসে কেন? যদিও তারা দেখতে যে, সবাই বউ সাজতে আসে। তখন সেখান আর পার্লার রাখলাম না। ২০১৭ সালের নভেম্বরে গুলশান-২-এর আজাদ মসজিদের উল্টোদিকে ৩ হাজার বর্গফুট আয়তনের ‘গালা মেকওভার স্টুডিও অ্যান্ড স্যালন’ বৃহত্ পরিসরে চালু করলাম। এতে কর্মসংস্থান হলো ২০ জন নারীর। নাভিনের তত্ত্বাবধানে ওই ২০ জন কর্মীর প্রশিক্ষণ চলল প্রায় চার মাস। ওই সময় প্রায় ৪০ লাখ টাকার বিনিয়োগে সহযোগিতা করেন আম্মা আফশা মাইজ উদ্দিন, শাশুড়ি সংগীতা আহমেদ ও খালা শাশুড়ি সামিনা সালমান।’ আধুনিক রূপচর্চার শতাধিক সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠান। স্যালনটির সঙ্গে কাজ করছে ওয়েডিং ডায়েরিসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমান ব্যস্ততা, গ্রাহকদের অভাবনীয় সাড়া, অল্প সময়ে সফলতার রহস্যটা জানতে চাইলে নাভিন আহমেদ বলেন, ‘গুণগত মানের সেবা আর পেশাদারিত্বই আমি আমার স্যালনে নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থেকেছি। পেশাদারিত্বের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় চলে আসে, যেমন—গ্রাহকবান্ধব আরামদায়ক পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, কর্মীদের আচরণ, গ্রাহকের চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়াসহ বিভিন্ন বিষয়। আধুনিক ও সময়োপযোগী রূপচর্চা সেবা দিতে হবে। গ্রাহকদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। আমরা এ বিষয়গুলো সবসময় নিশ্চিত করি। একটি নতুন স্যালন সাধারণত যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়, তার কোনোটিই ঘটেনি গালা মেকওভারের ক্ষেত্রে। কেননা গালা নতুন হলেও আমি রূপচর্চা সেবায় নতুন না।’
গা লা র ব্রা ই ডা ল মে ক ও ভা রে র বি শে ষ ত্ব
ব্রাইডাল মেকওভারের বিশেষত্ব প্রসঙ্গে নাভিন আহমেদ সাহস নিয়ে কিছু কথা বললেন। তার ভাষ্যে, ‘যখন আমি স্টার্ট করলাম, তখন শুধু পার্লারেই মেয়েরা সাজতে যেত। বাসায় গিয়ে সাজাত দু-একজন। পার্লারে মেকআপে ভালো কোয়ালিটির প্রোডাক্ট ব্যবহার করত না। সাধারণত গাউছিয়া বা চাঁদনিচক থেকে প্রোডাক্ট নিয়ে এসে মেকআপ করত। আমি যেহেতু মেকআপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করেছি, তাই বাইরের প্রোডাক্ট ব্যবহারে অভ্যস্ত। শুরু থেকে আমি বিদেশের ভালো প্রোডাক্ট ব্যবহার করি। এজন্য আমার ক্লায়েন্ট দ্রুত বাড়তে থাকল। কেননা আমার ক্লায়েন্টরা ভালো প্রোডাক্ট ব্যবহারকে অ্যাপ্রিশিয়েট করত। তারা কমেন্ট করত—আমাদের স্কিন ভালো রাখার জন্য মেকআপে ভালো প্রোডাক্ট ব্যবহার করাই উচিত। আজকাল ইয়াং মেয়েরা নিজের ত্বকের বিষয়েও বেশ সচেতন। তাই ভালো প্রোডাক্ট ব্যবহারে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মেকআপে ভালো প্রোডাক্ট ব্যবহার করি বলে আমরা অন্যদের তুলনায় মেকআপের চার্জ বেশি করি না। বর্তমানে স্টান্ডার্ড অন্য পার্লারের মতোই আমাদের ব্রাইডাল মেকআপ চার্জ।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হলো—দ্য স্টাইল অব মেকআপ। আমাদের দেশে যেটা বেশি ট্রেন্ড ছিল, তা হলো—ব্রাইডাল মেকআপ মানেই খুবই হেভি মেকআপ। তবে যারা একটু সিম্পল টাইপের পছন্দ করে বা ন্যাচারাল মেকআপ লুকটা পছন্দ করে, সাধারণত তারাই আমার মেকআপটা অ্যাপ্রিশিয়েট করল। আমি ক্লায়েন্টের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে তারা যেভাবে চায়, সেভাবে মেকআপ করা শুরু করলাম। যে লাইট মেকআপ চাইবে, তাকে ওই রকম মেকআপ আর যে ড্রামাটিক মেকআপ চাইবে তাকে তার পছন্দমতোই করে দিই। দেশের বাইরে সাধারণত ক্লায়েটের পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাই আমিও সেটা করে থাকি। দশ বছর থেকে ব্রাইডাল মেকআপ করছি বলে অনেকেই মনে করেন আমরা শুধু ব্রাইডাল মেকআপই করি। কিন্তু তা নয়, বর্তমানে আমাদের ফুল স্যালন হয়ে গেছে। এখন আমরা সব সার্ভিসই দিচ্ছি।’